নতুন শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে ভুল ধারণা

শিখন হবে অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন হবে যোগ্যতায় এই কারিকুলামের মূলকথা

শিক্ষার্থী শিখবে পরিবার, বিদ্যালয়, সহপাঠী ও কমিউনিটি থেকে। তাদের মূল্যায়ন শুধু শিক্ষকগণই করবেন না করবে পরিবার, সহশিক্ষাথী ও তার কমিউনিটি। স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হবে শিক্ষার্থীরা, শিক্ষক শুধু মেন্টরের ভূমিকা পালন করবে।
"বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর,
সবার আমি ছাত্র,
নানানভাবে নতুন জিনিস
শিখছি দিবারাত্র।"
কবি সুনির্মল বসুর এই কবিতাটি আমাকে খুব ভাবাতো, এখনো ভাবায়। আসলে শেখার আছে সবার থেকে। আর এই শিক্ষাটি হয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। নতুন কারিকুলামে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী শিখবে।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে শিক্ষা বলা হয় না "শিক্ষা হলো দক্ষতার পরিবর্তন, আচরণের পরিবর্তন, মনোভাবের পরিবর্তন।" শিক্ষার সংজ্ঞায় কোথাও লিখা নেই শিক্ষা মানে ভালো নম্বর, গ্রেড বা সার্টিফিকেট অর্জন। আমরা আগের কারিকুলামে শুধু নম্বরের পিছনেই দৌড়েছি। নম্বরের জন্য মুখস্থ করেছি, অন্যের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছি, কাউকে নিজের নোটস দেখানোর মতো উদারতা দেখাইনি, অন্যকে সহযোগিতা করিনি। আমাদের অভিভাবকরা বলতেন কাউকে দেখাবিনা। আর ভালো নম্বর পেয়ে গেলেই যা পড়েছি সব ভুলে যেতাম। আসলে যা মুখস্ত করে তাই ভুলে যায়। অথচ স্কুলে অবচেতন মনে যা শিখেছি যা কেউ শিখতে বলেনি সেটাই আমাদের মনে এখনো আছে। কোন একটা টপিক কেন পড়ছে এর উদ্দেশ্যে কখনো কেউ বলেননি এবং আমরাও বুঝার চেষ্টা করিনি। কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে বলি :
♦️আমরা বার বছর ইংরেজি পড়েছি, কিন্তু আমরা ওই ভাষায় কথা বলতে পারি না। অথচ তিন মাস ল্যাংগুয়েজ এর কোর্স করলে ঠিকই ইংরেজিতে কথা বলছে, এর কারণ মুখস্থ করেনি অভিজ্ঞতা এবং চর্চার মাধ্যমে শিখেছে। অভিভাবকরা বলছে গ্রামার নেই। এটি একেবারেই ভুল ধারণা। আগের কারিকুলামে আমাদের Tense এর আগে Structure শেখানো হতো পরে Example, এখন আগে Example দেখায় আর সেই Example থেকে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই Structure তৈরি করবে তাহলে কি তাদেরকে Structure মুখস্থ করতে হবে?
♦️অষ্টম শ্রেণির ছেলেকে যখন বলা হয় টাকা চেয়ে পিতার কাছে পত্র লিখ তখন ছেলে আমাকে বললো তুমি একটা পাগল, আমি কি চিঠি লিখে টাকা চাইব।আমি বাবাকে ফোন করবো আর বাবা বিকাশে টাকা পাঠিয়ে দিবে। তাহলে বলেন এই ফোর্থ জেনারেশনের যুগে শিক্ষার্থীদের এই ধরনের শিক্ষা দেওয়া হলে তারা কি বিশ্বের সাথে তাল মিলাতে পারবে? পেশার পরিবর্তন হচ্ছে, অনেক পেশা বিলুপ্ত হয়ে যাবে, আমাদের সন্তানদের চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বিশ্বের সাথে টিকে থাকার জন্যই এই কারিকুলাম।
♦️ফিজিক্সে অনার্স মাস্টার্স করে কয়জন শিক্ষার্থী নিজের পরিবারে ইলেকট্রিকের কাজ করতে পারে?অথচ দেখেন যে ইলেকট্রিক মিস্ত্রি আনি তার কোন সার্টিফিকেট নেই তাকে কি অশিক্ষিত বলবেন, শিক্ষার সংজ্ঞায় কিন্তু তা বলে না।
♦️সবাই বলছে এই কারিকুলাম নাকি বাচ্চাদের ডিভাইসমুখী করেছে। আচ্ছা কাজী নজরুল ইসলামের সংকল্প কবিতাটির শেষের দুই লাইনের কথা মনে আছে " বিশ্বজগত দেখবো আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে।" সত্যিই যার হাতে একটা স্মার্টফোন আছে বিশ্বটা তার হাতের মুঠোয়। অভিভাবকদের ভাবনার সাথে আমি একমত যে স্মার্টফোন একজন শিক্ষার্থীর জীবন ধ্বংস করে দিতে পারে, যেমন পৃথিবী ধ্বংস করে দিতে পারে আগুন।
একবার ভাবুন আগুন ব্যবহারে আমরা কতটা সচেতন, কিন্তু এই ভয়ংকর জিনিস কে জীবন থেকে বাদ দিলে আমরা বেঁচে থাকতে পারব না। স্মার্ট ফোনও আগুনের মতো একে জীবন থেকে ডিলিট করা যাবে না তাই এর ব্যবহারে সচেতন হতে হবে আর এতে পরিবারের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। আমাদের এখন জীবন দুটো।অবাক হচ্ছেন, হ্যাঁ একটা রিয়েল লাইফ আরেকটা ভার্চুয়াল লাইফ। দুই জায়গায় আমাদের সন্তানদের সার্ভাইব করতে হবে। নতুন কারিকুলামে ডিজিটাল প্রযুক্তি বিষয়ে প্রযুক্তির নৈতিক ও সচেতন ব্যবহার শিখবে ওরা।
♦️দলীয় কাজের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা শিখছে সহযোগিতা, সহমর্মিতা, উদারতা, নেতৃত্বদানের ক্ষমতা। পরিবারে সব সন্তান সমান থাকে না। কিন্তু পরিবার আমাদের শেখায় পারস্পরিক সহযোগিতা, এতে আন্তরিকতা বাড়ে,বিদ্যালয়ে সবল শিক্ষার্থী দুর্বল শিক্ষার্থী কে সবল করে তুলবে। দলীয় কাজের মাধ্যমেই যে বড়ো কিছু অর্জন করা যায় এর সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ হলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা।
♦️আমরা অভিভাবকরা পছন্দ করি সিট ও সিলেবাসভিত্তিক শিক্ষা।এই সিট ওনারা পাবেন আর বাচ্চাদের মুখস্থ করাবেন, তাই কোচিং সেন্টার ওনাদের স্কুল থেকে অনেক বেশি প্রিয়। সিট কখনো জীবন হতে পারে না, শিক্ষা হতে হবে পরিবেশ উপযোগী।
♦️নতুন সবকিছুই বাস্তবায়নে প্রথম দিকে সমস্যা থাকে। এই কারিকুলামে সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ ছিল অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থী আর অবকাঠামো। তবে এই ব্যাপারে সরকার যথেষ্ট উদ্যোগ নিয়েছে। এবার নতুন বছরে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শুধুমাত্র ৫৫ জন ভর্তি করানো হবে। সকল শিক্ষককে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হয়েছে। এই প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে ডিসেম্বরের ১ তারিখ হতে।
♦️বদলে যাচ্ছে জীবন ও জীবিকা, তাই জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে পরিবর্তন আসছে। এখন থেকে শিক্ষার্থী তার পরিবারের বাজেট তৈরি করবে, সঞ্চয় করা শিখবে, এমনকি আর্থিকভাবেও পরিবারকে সাহায্য করতে পারবে।
♦️রান্না শেখা কি খারাপ কোন কাজ? স্কুলে এক বা দুটো অভিজ্ঞতায় আছে এটা থেকে সে পরিবারে রান্না করার কাজে আগ্রহী হবে। যখন পরিবার থেকে আলাদা থাকবে তখন নিজের কাজ নিজেই করতে পারবে আর মায়ের এই কাজটা কে সম্মান করতে শিখবে, বুয়া হয়ে যাবে না। তাছাড়া রান্না করে পড়াশোনার পাশাপাশি ঘরে বসে ব্যবসা করতে পারবে। আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ হবে, এতে সে পরিবার ও দেশের সম্পদ হয়ে উঠবে। শিক্ষার্থীদের প্রতিটি শ্রমের কাছে নিয়ে যাওয়া বা তাদেরকে শিক্ষার্থীদের সামনে নিয়ে আসা এতে অন্যের শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়বে।
♦️গত ১৯ তারিখ বার্ষিক মূল্যায়নে ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ডিজিটাল প্রযুক্তি বিষয়ে "জরুরি পরিস্থিতিতে সংযুক্ত থাকি " সেমিনার আয়োজন করেছে। আমি অবাক হয়ে দেখেছি এত ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চারা তাদের নির্ধারিত বিষয় উপস্থাপন করেছে, এক দল আরেক দলকে ফিডব্যাক দিয়েছে, অন্যের মতামত কে প্রাধান্য দিচ্ছে, অতিথিদের ফিডব্যাক মনোযোগ সহকারে শুনেছে। অথচ এই সেমিনার শব্দের সাথে আমি পরিচিত হয়েছি অনার্স মাস্টার্স লেভেলে। তখন আমার মনে হয়েছে আমাদের সময় কেন এই কারিকুলাম ছিল না, কী বোকা মানুষের মতো আমাদের গরু, কুকুর, বিড়াল না দেখিয়ে আমাদের এগুলোর রচনা মুখস্থ করানো হয়েছে!
সহজভাবে ইংরেজি শিখতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন সুকুমার রায়ের জীবন হিসাব কবিতার কথা মনে হয় বাবু মশাই মাঝিকে অনেক জ্ঞানের কথা জিজ্ঞেস করে ছিল কিন্তু বোকা মাঝি কিছুই উত্তর দিতে পারেনি। তখন বাবু বলেছিল তোর জীবনের বার আনাই মিছে,ঠিক সেই সময়ে যখন নদীতে ঝড় উঠলো মাঝি বাবুকে জিজ্ঞেস করলো আপনি কি সাঁতার জানেন? বাবু বললেন না,তখন মাঝি বললো বেঁচে থাকলে আমার কথা হিসাব করো, তোমার জীবন খানা ষোল আনাই মিছে। এটা হলো আমাদের আগের কারিকুলামের অবস্থা। যারা কষ্ট করে আমার কথা গুলো পড়েছেন তাদের অসংখ্য ধন্যবাদ।

Post a Comment

0 Comments